একদল ছেলে যখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটির দিকে অশালীন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে, তখন তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে যে তাদেরই মধ্যে কারো না কারো একই বয়সী একটি বোন আছে। সেই বোনটিই যখন অন্য কারো দ্বারা একইরকম ঘটনার শিকার হচ্ছে এবং তার ইভটিজার ভাইটি তখন তার দলবল নিয়ে গিয়ে তার বোনকে ইভটিজিং করা ছেলেটিকে মারধর করে আসছে। প্রায়ই সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, মেয়েকে উত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাবা খুন বা মা খুন, বোনকে উত্যক্তকারীর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভাই খুন।
কিছুদিন আগের একটি ঘটনা। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে একটি শপিং মলের বাইরে মা, মেয়ে শপিং শেষে গাড়ির জন্য অপেক্ষমান। মা নিজেকে ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী পর্দায় মুড়ে রেখেছেন। অর্থাৎ বোরকা পড়েছেন, হাত ও পা মোজায় নিজেকে আপাদমস্তক আবৃত করেছেন, শুধুমাত্র চশমার ভেতর দিয়ে চোখ দুটি দৃশ্যমান। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ আধুনিক পোশাক পড়েছেন। আটোসাটো জিন্স আর গেঞ্জি। গেঞ্জিতে ইংরেজিতে লেখা ‘বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল’। মেয়েটি মহিলাটিকে ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করছিল, তাই বোঝা গেল তারা মা-মেয়ে। পাশেই কয়েকটি ছেলের একটি দল দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কাঁধে ব্যাগ এবং কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল তারা পাশ্ববর্তী কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তাদের পোশাক দেখেও বোঝা যাচ্ছিল তারাও যথেষ্ট আধুনিক। তারা মেয়েটিকে নিয়ে বিভিন্নরকম মন্তব্য করছিল। মেয়েটি শুনেও না শোনার ভান করছিল আর মায়ের কানে কথাগুলো সম্ভবত পৌঁছায়নি। আমি ছেলেগুলোকে বললাম, ভাই থামেন না। তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যে, তারা যা করছে সঠিক এবং আমি যা বললাম সেটা বেঠিক। তারা আমাকে বললো, আপনার বোন বা কিছু হয়? আমি বললাম, কারো না কারো তো হয়। এরপর সেই মা-মেয়ের গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার হাজির হলো এবং তারা চলে গেল। এরপর আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর ছেলেদের সেই দলটি আবারো মেয়েটিকে নিয়ে রসালো কিছু মন্তব্য করতে করতে চলে গেল। তাদের কথার শেষ যে লাইনটি আমার কানে এসেছিল, সেটি হচ্ছে মেয়েটিকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারলে মনের সাধ মেটানো যেত। এটি একটি পরোক্ষ ইভটিজিং এর উদাহরণ।
মেয়েটির পর্দানশীল মা যদি তাকে এমন পোশাকে নিয়ে বাইরে চলাফেরা করতে পারেন, তাহলে বাইরের লোকের কি কিছু বলার থাকতে পারে? ছেলেগুলোকে কে দায়িত্ব দিয়েছে এমন মন্তব্য করার। না রাষ্ট্র, না ধর্ম, না পরিবার, কেউ দেয়নি। কিন্তু তারা করেছে এবং করছে। দৃষ্টিভঙ্গি আর সঠিক সময়ে সঠিক যৌনশিক্ষার অভাবেই তাদের এই দুর্গতি। তারা পোশাকে আধুনিক হয়েছে ঠিকই কিন্তু মনের ভেতরটা নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকার কারণে কলুষিত।
ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গিয়ে তথাকথিত এক শ্রেণির পুরুষ নারীর পোশাক নিয়ে কথা তোলেন। পোশাকের শালীনতা, অশালীনতার কথা বলেন। তাদেরকে বলছি, যেহেতু মেয়েদের পোশাক নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো আইন নেই, সেহেতু তারা পোশাক হিসেবে কি বেছে নেবেন সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আর সেক্ষেত্রে পরিবারের বা অভিভাবকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ঘরের মেয়ে বাইরে যাবে- কি পোশাকে যাচ্ছে সেটা বড়জোর তার অভিভাবক কথা তুলতে পারেন। কেউ যদি পশ্চিমা বা অতিরিক্ত খোলামেলা পোশাকে নিজেকে আবৃত করে বাইরে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সেটা নিয়ে রাস্তায় মন্তব্য করার আপনি কেউ নন। আর অচেনা মেয়েদের নিয়ে মন্তব্য করার আগে নিজের ঘর আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে; তাদের মেয়ে নিয়ে আগে মন্তব্য করে সমাধান করুন। তারপর না হয় বলবেন রাস্তায় নেমে।
আর পুরুষরা সবদিক থেকেই নিজেকে আধুনিক করে তুলবেন, যুগের সাথে তাল মেলাবেন, উন্নতি টেকনোলজি ব্যবহার করবেন, তাহলে নারীদের পোশাকে আধুনিকতা কেন নয়। সংস্কৃতির আধুনিকায়ন তো হতেই পারে। তবে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি যা আমাদের বাঙালিয়ানার সাথে একবারেই খাপ খায় না, সেগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ জানাচ্ছি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্লোর ভাড়া নিয়ে সাময়িক উন্মাদনার জন্য তুলনামূলক সস্তা লেট নাইট ডিজে পার্টির আয়োজন করা হয়। তবে এটি এখন ভ্যালেন্টাইন ডে এবং থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে ঠিকানা পাল্টে রাজধানীর নামীদামি হোটেলগুলোতে চলছে। সেখানে যা হয় সেই দৃশ্য দেখলে বেহায়াপনা ছাড়া কিছুই মনে হবে না। এ ধরনের যত আয়োজন আছে প্রতিটির কারণে সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে। তবে তারকা যে হোটেলগুলো রয়েছে সেগুলোর আয়োজনের কথা অবশ্য আলাদা। সেখানে সমাজের উচুশ্রেণির মানুষরা সেখানে যায়, সোসাইটি মেইনটেইন করার জন্য। নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী তারা সেখানে যেতেই পারে। কিন্তু সস্তা আয়োজনের পার্টিগুলোতে গিয়ে নিজেদেরই পরোক্ষভাবে সর্বনাশ ডেকে আনছেন আমাদের যুবসমাজ।
পোশাকের শালীনতা অশালীনতা নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের বলছি- ধরে নিচ্ছি একটি মেয়ে অশালীন পোশাক পরেছেন। সেটা তার বাবা-মা বা অভিভাবক বুঝবেন। সেটা নিয়ে কি আপনাকে কেউ দায়িত্ব দিয়েছেন বন্ধুবান্ধব মিলে মন্তব্য করার বা শিস বাজানোর। এগুলো বয়সের কারণে হয়। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার। যৌনতা, নারী পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ ঈশ্বর প্রদত্ত। কিন্তু সেটারও সীমানা রয়েছে।
কেউ কেউ ধর্ষকের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন (কিছু অতি উচ্চশিক্ষিত মানবাধিকার কর্মী)। তারা মনে হয় একটা জিনিস বুঝতেই পারেন না যে যারা ধর্ষণ করেন, তারা তখন আর মানব থাকেন না মানবরূপী পিশাচ হয়ে যান। তাই পিশাচের অধিকার নিয়ে কথা তোলাটাও এক ধরনের বর্বরতা। তবে হ্যা, ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণেও অনেকে ধর্ষণের ফাঁদে পড়েন এবং ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন। সেজন্য রয়েছে আইন। আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু যখন খুব সহজেই বোঝা যায় যে একজন ব্যক্তি ধর্ষক, তাকে তার কৃতকর্মের প্রাপ্য শাস্তি অতি দ্রুত দেয়া উচিৎ। মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণের সর্বোচ্চ নয়, একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিৎ। তবে আরেকটি শাস্তি একজন ধর্ষকের জন্য আরো বেশি মানানসই হতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে এটি এখনও প্রচলিত। ধর্ষকের যৌনাঙ্গ কর্তন। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের একটি চমৎকার শাস্তি হতে পারে এটি এবং এরকম সাজা প্রচলন ও কার্যকর হলে ধর্ষণ করার আগে ধর্ষকরা হয়তো তার কর্তন করা যৌনাঙ্গের কথা একবার হলেও ভাবতো। যেহেতু বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত, সেহেতু এরকম একটি শাস্তির কথা বলা যেতেই পারে। এখন কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড নেই- তার দোহাই দিয়ে কেউ যদি মানবাধিকার কচলানো শুরু করেন, সেটা এখানে খাটবে না।
ইভটিজিং একটি ভয়াবহ ভাইরাসের মত সমাজকে গ্রাস করছে, বহুলাংশেই যার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় ধর্ষণ। সকলকে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশটা আমাদের সকলের। এখানে ইভটিজার এবং ধর্ষকরা তাদের অপকর্মের মাধ্যমে বর্বরতার কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ালে আমাদের একটা সময় নিঃশ্বাস নিতে বেগ পেতেই হবে। তাই এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সমাজে অক্সিজেন আমাদেরই বাড়াতে হবে।
ইভটিজিং এর পর আরো বেশি উত্যক্ত, তারপর লাঞ্ছিত, শ্লীলতাহানি, সবশেষে ধর্ষণ দিয়ে শেষ হয় ইভটিজারদের দূষিত আকাঙ্খা। তাই খুব সহজেই বলা যায়- আজকের ইভটিজার, ভবিষ্যতের ধর্ষক।